চট্টগ্রামের উপকূলে গড়ে উঠেছিল ‘শেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়াম’। বাইরে থেকে মনে হতো এটি শিশুদের ক্রীড়া বিকাশে একটি মহৎ উদ্যোগ। কিন্তু ভিতরের চিত্র ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। সরকারি জমি দখল করে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে গড়ে তোলা হয়েছিল একটি অবৈধ সাম্রাজ্য।
রোববার (১৩ জুলাই) চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নেতৃত্বে পরিচালিত উচ্ছেদ অভিযানে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় স্টেডিয়ামসহ সংলগ্ন কাভার্ডভ্যান ইয়ার্ড, স্কেভেটর ইয়ার্ড ও চীনা কোম্পানিকে ভাড়া দেওয়া স্থাপনাসমূহ।
জানা গেছে, স্টেডিয়ামটি পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) ৪০ একর খাসজমির ওপর নির্মিত ছিল। এই জমির বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ৩২০ কোটি টাকা। দীর্ঘদিন ধরে এটি দখলে রেখেছিলেন ক্ষমতাসীন দলের সাবেক ও বর্তমান নেতারা।
অভিযানে নেতৃত্ব দেন কাট্টলী সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) হুছাইন মুহাম্মদ। সঙ্গে ছিলেন পতেঙ্গা সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) ফারিস্তা করিম, জেলা প্রশাসনের মো. মঈনুল হাসান এবং পাউবো চট্টগ্রামের নির্বাহী প্রকৌশলী শওকত ইবনে সাহীদ।
প্রকৌশলী শওকত বলেন, ‘স্টেডিয়ামসহ পুরো এলাকাজুড়ে কেবল সরকারি জমিতেই গড়ে তোলা হয়েছিল কাঠামো। প্রথমদিনে ১২ একর জমি উদ্ধার করা হয়েছে। পুরো ৪০ একর জমি উদ্ধারে অভিযান চলবে ১৫ জুলাই পর্যন্ত। এরপর সীমানা পিলার বসিয়ে কাঁটাতারের বেড়া ও পরিকল্পিত বনায়ন করা হবে।’
২০২২ সালের ১৯ অক্টোবর চট্টগ্রাম নগরীর উত্তর কাট্টলীতে শেখ রাসেলের জন্মদিন উপলক্ষে যাত্রা শুরু করে শেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়াম। হোসনে আরা মনজুর ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের অর্থায়নে নির্মিত এই স্টেডিয়ামের উদ্বোধন করেন চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র এম মনজুর আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন সংসদ সদস্য দিদারুল আলম, মোস্তফা হাকিম গ্রুপ ও ট্রাস্টের পরিচালক মোহাম্মদ সাইফুল আলম এবং মনজুর আলমের নাতি নাবিদ আব্দুল্লাহ মনজুর আলম।
অনুষ্ঠানে সাবেক মেয়র এম মনজুর আলম বলেন, ‘আমি এবং আমার পরিবার বঙ্গবন্ধুর আদর্শের একটি পরিবার। জাতির জনক, বঙ্গমাতা ও শেখ রাসেলের আত্মার মাগফিরাতের জন্য আমাদের নানা কর্মসূচি থাকে। আমরা চাই শেখ রাসেল বেঁচে থাকুক তরুণ প্রজন্মের মাঝে। এজন্য এই স্টেডিয়ামের নাম দিয়েছি শেখ রাসেলের নামে।’
প্রথমদিকে এমন সব আশাবাদ ব্যক্ত করা হলেও বাস্তবে সেটি হয়ে উঠেছিল মোস্তফা হাকিম পরিবারের দখলবাণিজ্যের বৈধতার মুখোশ।
মনজুর আলম দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। উত্তর কাট্টলী থেকে তিনবার কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। ২০১০ সালে তিনি বিএনপিতে যোগ দিয়ে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন। তবে ২০১৫ সালে পরাজয়ের পর পুনরায় আওয়ামী লীগে ফিরে যান এবং সক্রিয় রাজনীতিতে যুক্ত থাকেন।
জানা গেছে, স্টেডিয়ামের আশপাশের আরও প্রায় সাত একর জমিতে গড়ে তোলা হয়েছিল বাণিজ্যিক স্থাপনা, যার পেছনে ছিলেন মনজুর আলমের ভাতিজা ও সাবেক এমপি দিদারুল আলম। তিনি চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুণ্ড ও উত্তর কাট্টলী) আসন থেকে দুবার আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ছিলেন।
এছাড়াও ৩০ একরের বেশি খাসজমি দখল করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়েছেন সাবেক প্যানেল মেয়র নিছার উদ্দিন আহমেদ, সাবেক কাউন্সিলর আবুল হাসেমসহ আরও কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা। এসব জমি ধাপে ধাপে পুনরুদ্ধারের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে প্রশাসন।
উদ্ধার করা জমিতে সীমানা চিহ্নিত করে কাঁটাতারের বেড়া ও বনায়নের মাধ্যমে সরকারিভাবে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হবে। তবে স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে—এই উচ্ছেদ কেবল অবৈধ স্থাপনার নয়, এটি এক দীর্ঘদিনের ‘নীরব দখলচক্রের’ বিরুদ্ধে প্রশাসনের সরাসরি আঘাত। যে চক্রের পৃষ্ঠপোষকতা ছিল রাজনীতির সর্বোচ্চ করিডোরে।